প্রয়াত ঝাড়খণ্ডের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এবং ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা শিবু সোরেন। সোমবার রাতে দিল্লির একটি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন তিনি। মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ৮১ বছর। দীর্ঘদিন ধরেই অসুস্থতায় ভুগছিলেন তিনি। বর্তমানে রাজ্যসভার সদস্য পদে ছিলেন শিবু সোরেন। তাঁর ছেলে ও বর্তমান ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেন নিজেই তাঁর বাবার মৃত্যুর খবর ঘোষণা করেন।
ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেন এক্স হ্যান্ডেলে জানিয়েছেন তাঁর বাবার মৃত্যু সংবাদ।আবেগঘন বার্তায় তিনি লেখেন, 'সম্মানীয় দিশোম গুরু আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছেন। আজ আমি একেবারে শূন্য হয়ে গেলাম।' 'দিশোম গুরু' বা ‘মহান নেতা’ নামে পরিচিত শিবু সোরেন ছিলেন ভারতের আদিবাসী রাজনীতির এক অগ্রগণ্য মুখ। তিনি তিনবার ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন এবং কেন্দ্রীয় সরকারের কয়লা মন্ত্রকের দায়িত্বও সামলেছেন একাধিকবার। গত কয়েক মাস ধরেই শরীর ভাল যাচ্ছিল না ঝাড়খণ্ড আন্দোলনের নেতা শিবু সোরেনের। জুন মাসে তাঁকে ভর্তি করানো হয় দিল্লির গঙ্গারাম হাসপাতালে। শিবু সোরেনের কিডনির সমস্যা ছিল। সম্প্রতি তাঁর মস্তিষ্কের ভিতর রক্তক্ষরণও হয়। এই অবস্থায় শুক্রবার প্রবীণ এই রাজনীতিকের শারীরিক পরিস্থিতির অবনতি হয়। তাঁকে রাখা হয় ভেন্টিলেশনে। চিকিৎসকেরা জানিয়েছিলেন, শিবুর শারীরিক পরিস্থিতি কিছুটা স্থিতিশীল হলেও নতুন করে উন্নতিও হয়নি। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা তাঁর চিকিৎসার দায়িত্বে ছিলেন। কিন্তু শেষরক্ষা হল না।
শিবু সোরেনের প্রয়াণে শোকপ্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তৃণমূল স্তর থেকে উঠে আসা এই রাজনীতিকের আদিবাসীদের উন্নয়নে উদ্যোগের কথা বিশেষভাবে স্মরণ করেছেন প্রধানমন্ত্রী।প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এক্স-এ লিখেছেন, 'শ্রী শিবু সোরেন জি ছিলেন একজন তৃণমূল স্তরের নেতা যিনি জনগণের প্রতি অটল নিষ্ঠার সঙ্গে জনজীবনের বিভিন্ন স্তরে উঠে এসেছিলেন। তিনি বিশেষ করে উপজাতি সম্প্রদায়, দরিদ্র ও নিপীড়িতদের ক্ষমতায়নের প্রতি আগ্রহী ছিলেন। তাঁর মৃত্যুতে আমি মর্মাহত। তাঁর পরিবার এবং ভক্তদের প্রতি আমার সমবেদনা। ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী শ্রী হেমন্ত সোরেন জি-র সঙ্গে কথা বলেছি এবং সমবেদনা জানিয়েছি। ওম শান্তি।'
রাজনৈতিক শিকড়
১৯৪৪ সালের ১১ জানুয়ারি বর্তমান ঝাড়খণ্ডের নেমরা গ্রামে সাঁওতাল আদিবাসী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন শিবু সোরেন। যা সেই সময় বিহারের অংশ ছিল। শৈশবে তাঁর বাবা স্থানীয় জমিদারদের হাতে নিহত হন, যা তাঁর জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে। সেখান থেকেই শুরু হয় তাঁর জীবনের লড়াই। ভূমির অধিকার ও আদিবাসী সুরক্ষার দাবি তোলেন তিনি। গ্রামীণ আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন তিনি। আদিবাসীদের জমির উপর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সংগঠিত করেন কৃষক-শ্রমিকদের। এই আন্দোলনের মধ্য দিয়েই গড়ে ওঠে ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা।বামপন্থী ট্রেড ইউনিয়ন নেতা এ কে রায় এবং কুর্মি মাহাতো নেতা বিনোদ বিহারী মাহাতোর সঙ্গে জোট বেঁধে১৯৭২ সালে ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা গঠন করেছিলেন তিনি। ২০০০ সালে বিহার থেকে আলাদা হয়ে পৃথক ঝাড়খণ্ড রাজ্য গঠনের পিছনে তাঁর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল।
শিবু সোরেন আদিবাসী জনগণের কাছে 'দিশোম গুরু' নামে জনপ্রিয় ছিলেন। কিন্তু তাঁর রাজনৈতিক জীবন বিতর্ক থেকেও মুক্ত ছিল না। ২০০৬ সালে একটি হত্যা মামলায় তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করা হলেও পরে আদালতের নির্দেশে সেই রায় বাতিল হয়ে যায়।
রাজনৈতিক যাত্রা
১৯৮০ সাল থেকে ২০০৫ পর্যন্ত ছয়বার লোকসভা সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন শিবু সোরেন। পাশাপাশি রাজ্যসভাতেও তিনবার নির্বাচিত হন তিনি। ২০০৪ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে তিন দফায় কেন্দ্রীয় কয়লা মন্ত্রকের দায়িত্ব সামলেছেন তিনি।পরে কয়লা কেলেঙ্কারিতেও তাঁর নাম জড়িয়েছিল।শিবু সোরেন তিনবার ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন। মার্চ ২০০৫ (মাত্র ৯ দিনের জন্য), আগস্ট ২০০৮ থেকে জানুয়ারি ২০০৯ এবং ডিসেম্বর ২০০৯ থেকে মে ২০১০-পর্যন্ত ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন তিনি। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে কোনওবারই পূর্ণ মেয়াদ শেষ করতে পারেননি। ১৯৮৭ সালে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা-এর সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ২০২৫ সালের এপ্রিল পর্যন্ত তিনি টানা ওই পদে বহাল ছিলেন। প্রায় চার দশক ধরে তিনি ছিলেন দলের প্রধান চালিকাশক্তি ও আদিবাসী রাজনীতির মুখ।
রাজনৈতিক পরিবার
শিবু সোরেনের পুত্র হেমন্ত সোরেন বর্তমানে ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর পুত্রবধূ এবং হেমন্ত সোরেনের স্ত্রী কল্পনা সোরেনও একজন বিধায়ক। তাঁর ছোট ছেলে বসন্ত সোরেনও দুমকার বিধায়ক।ঝাড়খণ্ডের আদিবাসী রাজনীতির প্রাণপুরুষ হিসেবে পরিচিত শিবু সোরেনের মৃত্যুতে রাজ্য তথা দেশের রাজনৈতিক মহলে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।