ভারতের নানা সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি, রীতি ও ঐতিহ্যের সুনাম রয়েছে বিশ্বজুড়ে। সমস্ত ধর্ম, জাত নির্বিশেষে ঐতিহ্যের ছাপ এখনও রয়েছে বিবাহের রীতি, রেওয়াজে। নাচ, গান, সাজসজ্জায় চমক, নানা রীতিতে ঠাসা থাকে বিয়ের অনুষ্ঠানগুলি। যা প্রায়ই সকলের নজর কাড়ে।তবে হিমাচল প্রদেশের সিরমৌর জেলার একটি ছোট গ্রামে সম্প্রতি এমন এক ভারতীয় বিবাহের প্রাচীন রীতির সাক্ষী থাকল সকলে, যা সাধারণত লোকচক্ষুর আড়ালেই থেকে যায়। দুই ভাইয়ের সঙ্গে এক মহিলার বিয়ে। এই রীতির নাম, হট্টি পলিয়ান্দ্রি।
হিমাচল প্রদেশের এক রীতি অনুযায়ী, এক পাত্রীকে দুই ভাই বিয়ের করেন।সম্প্রতি শিল্লাই গ্রামের প্রদীপ নেগি ও কপিল নেগি বিয়ে করেছেন কুনহাট গ্রামের সুনীতা চৌহানের সঙ্গে। ট্র্যাডিশনাল হাট্টি সম্প্রদায়ের নিয়ম মেনেই এই বিয়ে হয়। স্থানীয়ভাবে পরিচিত ‘জোড়িদারন’ বা ‘দ্রৌপদী প্রথা’ নামে, এই প্রাচীন রীতি অনুযায়ী ভাইয়েরা একসঙ্গে একই স্ত্রীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।তিনদিন ধরে চলা এই বিয়েতে যোগ দেন বহু আত্মীয়, প্রতিবেশী ও হাট্টি সম্প্রদায়ের সদস্যরা। অতিথিদের পরিবেশন করা হয় ট্রান্স-গিরি অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী খাবার, যা বিশেষত বিয়েতে পরিবেশন করা হয়।বিয়ের অনুষ্ঠান ঐতিহ্যবাহী ট্রান্স-গিরি খাবারের আয়োজন করা হয়েছিল। পাহাড়ি গানে মেতেছিল গোটা বিয়েবাড়ি। ঐতিহ্যবাহী রীতিগুলিও ছিল নজরকাড়া। দিনভর নাচগান, হুল্লোড়ে মেতেছিলেন সকলে। আনন্দে মেতেছিলেন নবদম্পতিও।
আরও পড়ুন-ভারতীয় বিয়ের সঙ্গে চিনা শেষকৃত্য! মালেয়শিয়ায় অন্যরকম বোঝাপড়া সাক্ষী বিশ্ব
জানা গেছে, প্রদীপ জল শক্তি দফতরের কর্মী এবং কপিল বিদেশে হসপিটালিটি ইন্ড্রাস্ট্রিতে কর্মরত। দু'জনে দুই দেশে থাকলেও, সম্প্রদায়ের প্রাচীন রীতি মেনে বিয়েতে রাজি হন। সুনিতার সঙ্গে আলাপ পরিচয়ের পর তাঁদের পছন্দ হন। দু'জনেই সুনিতাকে বিয়ের সিদ্ধান্ত নেন। সুনিতা জানিয়েছেন, 'আমাকে কেউ বিয়ের জন্য জোরাজুরি করেননি। দ্রৌপদী প্রথার বিয়ের রীতি আমি আগে থেকেই জানতাম। সব রীতি, রেওয়াজ জেনেই এই বিয়েতে আমি সম্মতি জানিয়েছিলাম।' অন্যদিকে প্রদীপ নেগি বলেন, 'এই সিদ্ধান্ত পারস্পরিক। আমাদের বিশ্বাস, একে অপরের প্রতি বিশ্বাস, যত্ন ও দায়িত্ববোধই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমরা গোপনে নয়, প্রকাশ্যে এই বিয়ে করলাম, কারণ আমরা আমাদের ঐতিহ্য নিয়ে গর্বিত।' কপিল বলেন, 'আমি বিদেশে থাকলেও, এই বিয়ে আমাদের স্ত্রীর সুরক্ষা ও ভালবাসা নিশ্চিত করবে। আমরা একসঙ্গে আছি, এটাই গুরুত্বপূর্ণ।'
হিমাচল প্রদেশের হট্টি সম্প্রদায়ের এই পলিয়ান্দ্রি বিয়ের রীতি দ্রৌপদী প্রথা নামেও পরিচিত। হিমাচলের সিরমুর ছাড়াও, উত্তরাখণ্ডের কয়েকটি এলাকায় এই রীতি মেনে বিয়ের চল রয়েছে। একাধিক ভাইয়ের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন কনে। পৈতৃক ভিটে যাতে ভাগাভাগি না হয়, কোনও স্ত্রী যাতে এক ভাইয়ের মৃত্যুর পর বিধবা না হন, তার জন্যেই একাধিক ভাইয়ের সঙ্গে একজনের বিয়ে দেওয়া হয়। এতে পরিবারে সুখ, শান্তিও বজায় থাকে। যদিও আধুনিক সময়ে এর প্রচলন ধীরে ধীরে কমেছে, তবু কিছু পরিবারে এখনও এই রীতিকে সম্মানের সঙ্গে রক্ষা করা হয়।তবে হিমাচলের বাসিন্দা দুই ভাই সেই প্রাচীন রীতি মেনে বিয়ে করায়, আবারও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছেন।
আরও পড়ুন-ভারতীয় বিয়ের সঙ্গে চিনা শেষকৃত্য! মালেয়শিয়ায় অন্যরকম বোঝাপড়া সাক্ষী বিশ্ব
উল্লেখ্য, সম্প্রতি হট্টি জনজাতি শিডিউলড ট্রাইবের স্টেটাস পেয়েছে। হিমাচল প্রদেশের হাইকোর্টও জোড়িদার আইনের অধীনে এই বিবাহকে সংরক্ষণ করেছে। তবে এই প্রথাও ধীরে ধীরে অবলুপ্ত হচ্ছে। হট্টি সেন্ট্রাল কমিটির জেনারেল সেক্রেটারি কুন্দন সিং শাস্ত্রী এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, এই প্রথা ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। গ্রামবাসীরাও এখন শিক্ষার আলো পাচ্ছেন। অনেকেই কর্মসূত্রে শহরে চলে যাচ্ছেন। এই রীতিতে বিয়ে করতে বিশেষ কেউ আর রাজি হয় না।